ফাতিমা আল-ফিহরি। পুরো নাম ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল-ফিহরিয়া আল-কুরাইশিয়া। নাম দেখেই অনুমান করা যায় তিনি কোরাইশ বংশের একজন উত্তরাধিকারী। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমান তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে তার জন্ম। এই শহরটি একসময় ইসলামিক শিক্ষা, সভ্ভতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু কেন আমরা এই নারীকে নিয়ে কথা বলছি? কি এমন করেছেন তিনি?
পৃথিবীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১০৮৮ সালে। তারও ১০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মিশরের বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নয়। প্রায় সাড়ে এগারোশো বছর আগে মরোক্কতে কারাউইন ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইউনেস্কো এবং গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী এটিই পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, যা আজও শিক্ষা দান করে যাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আর কেউ নন, এক মুসলিম মহিয়সী নারী- ফাতিমা আল-ফিহরি।
৬৭০ খ্রিস্টাব্দে তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে উমাইয়া শাসন শুরু হয়। সেইসময় আল-ফিহরি পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিল। সেখানে তারা তেমন কোন কাজ করে ভালো উপার্জন করতে পারছিলেন না। তাই নবম শতকের দিকে আল-ফিহরি পরিবার মরোক্কোর ফেজ শহরের দিকে পাড়ি জমান। সেইসময় ফেজের শাসক ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপ্রাণ নেতা সুলতান দ্বিতীয় ইদ্রিস। তিনি ফেজে আসা অভিবাসীদের জন্য ফেজ নদীর তীরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ফেজে এসে প্রচন্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন সফল ব্যাবসায়ীতে পরিণত হন ফাতিমার বাবা মোহাম্মদ আল ফিহরি। ছেলে-মেয়েদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ফাতিমা ও তার বোন মারিয়াম ইসলামিক আরবি ভাষা, ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রের উপর পড়াশোনা করেছেন। ফাতিমার বিয়ের পর এক দুর্ঘটনায় তার বাবা, মা, ভাই, স্বামী সকলেই মারা যান। রয়ে যায় শুধু তারা দুই বোন- ফাতিমা ও মারিয়াম এবং তার বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি। এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েও তারা এই সম্পদের কোনো অপব্যয় করেননি , বরং মানবতার কাজে ব্যয় করেছেন।
ফেজ সমৃদ্ধশালী শহর হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা দলে দলে এই শহরে ছুঁটে এসেছে। কিন্তু ফেজের যে কেন্দ্রীয় মসজিদে তারা নামাজ পড়তেন, সেখানে সবাইকে একসাথে জায়গা দেয়া আর সম্ভব হচ্ছিলো না। এই কথাটি অনুধাবন করে ফাতিমা ও মারিয়াম সিদ্ধান্ত নেন, এই মুসলমানদের নামাজের জন্য মসজিদ নির্মাণ করবেন। তাই, কাছাকাছি এলাকায় মারিয়াম নির্মাণ করেন আন্দালুস মসজিদ এবং ফাতিমা নির্মাণ করেন কারাউইন মসজিদ।
চতুর্দশ শতকের ইতিহাসবিদ ইবনে আবি-জারার লেখা ফেজ শহরের ইতিহাস, “The Garden of Pages”- এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, এক রমজান মাসের পবিত্র দিনে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফাতিমা নিজে মসজিদ নির্মাণের তদারকি করেছেন। তার বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরুর দিন থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ফাতিমা রোযা রেখেছিলেন। মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিলো প্রায় ১৮ বছর। কিন্তু এই সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের অনেক মতভেদ আছে। কারও মতে মসজিদটি তৈরী হতে সময় লেগেছিলো ১১ বছর আবার কেউ কেউ বলেন মাত্র ২ বছরেই এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। আর যেদিন মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল, ফাতিমা প্রথম সেই মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।
ফাতিমার তৈরী এই কারাউইন মসজিদটি একসময় আফ্রিকার বৃহত্তম মসজিদ ছিল। বর্তমানে এই মসজিদে প্রায় বাইশ হাজার মুসলমান একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদের পাশেই তিনি একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন। প্রথমে সেখানে শুধু আরবি শিক্ষা দেয়া হলেও ধীরে ধীরে চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, রসায়ন, ব্যাকরণ, ভূগোল, ইতিহাসসহ আরও অনেকে বিষয়ে জ্ঞানদান করা শুরু হয়। পৃথিবীর মধ্যে এটিই প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে ডিগ্রি প্রদান করা হতো। প্রায় সাড়ে এগারোশো বছর ধরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজও মানুষকে তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে যাচ্ছে।
একসময় এই কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদের জন্য ফেজ শহরটি আফ্রিকার ইসলামী শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। মুসলমান ছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিখ্যাত খ্যাতিমান ইহুদি ও খ্রিস্টান বাক্তিরাও জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তার এই জ্ঞান ইউরোপের আনাচে কানাচে ছড়িয়েও দিয়েছিলেন। ০ (শূন্য) সম্পর্কে ধারণার ইউরোপীয়রা প্রথম তার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। মালিকি বিচারপতি ইবনে আল-আরাবি, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এবং জ্যোতির্বিদ নূরুদ্দীন আল-বিতরুজি- র মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত মনীষীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করেছিলেন। এমনকি ফাতিমা নিজেও কিছুদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিও বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে প্রায় ৪০০০ এর মতন প্রাচীন, দুর্লভ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে নবম শতকের লেখা কোরআন শরীফ, হাদিসের সংকলন, ইবনে ইসহাকের লেখা রাসুল (সা)-এর জীবনী, আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপি, ইমাম মালিকের গ্রন্থ মুয়াত্তা, ইবনে খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার- সহ আরও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ। যদিও আগুনে পুড়ে আরও বেশ কিছু গ্রন্থ পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও যা রক্ষিত আছে তার মূল্যও পৃথিবীর কাছে কম নয়।
মহিয়সী এই নারী ফাতিমা আল ফিহরি ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিজের মহিমায়। তার প্রতিষ্ঠিত এই কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করছে আর বিশ্বের দরবারে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তাই এই বিশ্ব ফাতিমা আল ফিহরির কাছে চিরঋণী হয়ে আছে, থাকবে। পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করার জন্যে তার অবদান অপরিসীম।
Images Collected From Google