চিত্র নায়ক রাজ্জাক আমাদের রূপালী পর্দার নায়করাজ। প্রথম স্থির চিত্রটি ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “প্রতিশোধ” ছবি থেকে নেয়া। দ্বিতীয় চিত্রটি নেয়া হয়েছে ১৯৭৬ সালের “কি যে করি” ছায়াছবি থেকে। তৃতীয় চিত্রটি “বেঈমান” (১৯৭৪) চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাঁর ইম্পালা গাড়ীটি, যা’ এই ছায়াছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। স্যুট সহ চতুর্থ চিত্রটি কোনও চলচ্চিত্রের নয়, তিঁনি সত্তর শতকে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিলেন। ছবিটিই বলে দিচ্ছে, রাজ্জাক আসলে কত স্মার্ট, স্টাইলিশ এবং সুদর্শন ছিলেন!
নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন বহুমুখী অভিনেতা। ১৯৭০ দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত বাছাইকৃত বারোটি ছায়াছবিতে তাঁর অভিনীত বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে নিয়ে সাজানো হয়েছে নায়করাজের উপর এই আজকের এই সংক্ষিপ্ত “সিটি ট্যুর”!
১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে, আমাদের স্বাধীনতার আগে, “প্রতিশোধ” ছবিতে রাজ্জাককে দেখা যায় মাথায় পাগড়ী পরা এক শিখের চরিত্রে। ছবিটি রাজ্জাকের অভিনয় জীবনের প্রথম দিকের। এই ছবিতে রাজ্জাকের শক্তিশালী অভিনয় তখন জানান দিয়েছিলো তাঁর দুর্দান্ত প্রতিভার কথা। পরবর্তীতে, “ওরা এগারো জন” (১৯৭২) ছায়াছবিতে পারভেজ চরিত্রের রূপায়ণ এবং নির্যাতনের দৃশ্যে তাঁর অভিনয় এতটাই বাস্তব ছিল যে দর্শকদের অনেকেই দৃশ্যতঃ বিচলিত বোধ করতেন সিনেমা হলে।
“অবুঝ মন” (১৯৭২) ছবিতে রাজ্জাকের ডাঃ মাসুম চরিত্রের অভিনয় ছিল অসামান্য। সিনেমার প্রথমার্ধে তাঁর কমেডী এখনো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে অনেকের কাছে। ‘রংবাজ’ (১৯৭৩) ছবিতে রাজা চরিত্রটিতে রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অবিশ্বাস্য। একই বছর, রাজ্জাক একটি রিকশা চালকের (হাশেম হিসাবে) চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন “অনির্বাণ” (১৯৭৩) ছবিতে। এই ছবিতে দেখা যায় রাজ্জাক একটি পা হারিয়ে ক্র্যাচের উপর ভর করে চলাফেরা করছেন। রাজ্জাকের এমন বাস্তব অভিনয় ছিল অসাধারণ।
“বেঈমান” (১৯৭৪) ছবিতে রাজ্জাক নাসিমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিতে তিঁনি অজান্তেই নিজের বাবাকে হত্যা করে ফেলেন। এ হত্যাই রাজ্জাকের জীবনে এনে দেয় চরম হতাশা, তাঁকে হতে হয় অসম্ভব অনুতপ্ত। এই কঠিন মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে তিঁনি অভিনয়ের মাধ্যমে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ছবিটিতে। এই ছবিতে রাজ্জাকের মৃত্যুর দৃশ্য ছিলো বাংলা ছায়াছবির জগতের এক টার্নিং পয়েন্ট। সেই সময় রাজ্জাকের এমন বিয়োগান্ত এক চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় ছিল অনেকের কাছে অকল্পনীয়।
এদিকে “বাঁদী থেকে বেগম” (১৯৭৫) ছবিতে নবাব আলী নওশেরের ভূমিকায় নায়করাজের অভিনয় ছিল দেখার মতো। এই ছায়াছবির আবহ, গল্পের আঙ্গিক, এবং চিত্রনাট্য ছিল বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। “কি যে করি” (১৯৭৬) ছবিতে রাজ্জাকের ছাপা লুঙ্গি আর রাজেশ খান্না পাঞ্জাবী পরে বাদশা চরিত্রের অভিনয় ছিল অনেকদিন মনে রাখার মতো। এই ছায়াছবিতে তাঁর কৌতুক ভুলতে পারবে কে? এই ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন রাজ্জাক। এই ছায়াছবিটির কাহিনী বিন্যাস ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রমী।
১৯৭৭ সালে নায়করাজ “অতিথি” ছবিতে হিরু আহমেদের চরিত্রে অভিনয় করেন। হিরু ছিল একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় হিন্দি সংস্করণ “দুশমন”এ একই চরিত্রে অভিনয় করা রাজেশ খান্নার চেয়েও অনেক বাস্তব মনে হয়েছে অনেকের কাছে। “অশিক্ষিত” (১৯৭৮) ছবিতে রাজ্জাকের নাইটগার্ড রহমতের ভূমিকায় অভিনয় তাঁকে এনে দেয় আরও একটি জাতীয় পুরষ্কার। একই বছরে “আসামী” ছবিতে সেলিমের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় ছিল অনবদ্য।
অবশেষে “ছুটির ঘন্টা” (১৯৭৯-৮০) ছবিতে বিদ্যালয়ের পিয়ন, আব্বাসের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় কে ভুলতে পারে সহজে? সে এক অসামান্য অভিনয়! ১৯৬০, ১৯৭০ দশকে এবং তারপরেও অন্যান্য বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় বাংলার মানুষ মনে রাখবে অনেক-অনেক দিন। বাংলাদেশের ছায়াছবির ইতিহাসেও রাজ্জাক নিয়ে রেখেছেন অনেকটুকুই স্থান!
নায়করাজের সাথে দেশী-বিদেশী অন্য কোনো অভিনেতার তুলনা করা আর আপেলের সাথে কমলার তুলনা করা একই কথা। রাজ্জাকের অভিনয়ের একটি নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে।
তাই, নায়করাজের তুলনা নায়করাজ নিজেই!